সংবাদ ডেস্ক : বাংলাদেশের হেঁশেলে পেঁয়াজ নিত্যপণ্য। দেশের প্রতিটি চুলাই পেঁয়াজ নামের মসলাটিকে ভালোভাবে চেনে। প্রায় প্রতিটি রান্নার পদে—হোক সেটা চিকেন ফ্রাই, আলুর ভর্তা কিংবা বিরিয়ানি—পেঁয়াজ লাগবেই। তাই এই পণ্যের দাম আকাশছুঁলেই দেশের লাখ লাখ রাঁধুনির কান্না ঝরে পড়ে মাটিতে।
পেঁয়াজ নিয়ে বছরের বেশিরভাগ সময় আলোচনা লেগেই তাকে। কখনো দাম বেড়ে তিনশ’ টাকায় ঠেকে, আবার কখনো ১০০ টাকায় চার কেজি পেঁয়াজও মেলে। পেঁয়াজ উৎপাদনে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ না হওয়ায় মূলত এমন কাণ্ড ঘটছে দেশীয় বাজারে। দেশে পেঁয়াজের চাহিদা মেটাতে ৪৩ ভাগই বিদেশ থেকে, প্রধানত ভারত থেকে আমদানি করতে হয়। এ কারণেই পেয়াঁজের ব্যাপারে ভারত কোনো সিদ্ধান্ত নিলে তার প্রভাব পড়ে দেশের আনাচে-কানাচেও।
বাংলাদেশের কৃষি অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে পেঁয়াজের চাহিদা রয়েছে ৩০ লাখ টনের মতো। চলতি বছরে দেশে পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছে ২৫ লাখ ৫৭ হাজার টন। বিভিন্ন কারণে এর মধ্যে গড়ে ২৫-৩০ শতাংশ নষ্ট হয়ে যায়। ফলে দেশে মোট পেঁয়াজের উৎপাদন গিয়ে দাঁড়ায় ১৮ থেকে ১৯ লাখ টনে।
দেশের রাঁধুনিদের চাহিদা পূরণ করতে বাকি প্রায় ১১ লাখ টন পেঁয়াজ আমদানি করতে হয়। ভারত ছাড়াও মিয়ানমার, মিশর, তুরস্ক, পকিস্তান, চীন থেকেও বাংলাদেশে পেঁয়াজ আমদানি হয়ে থাকে। তবে সেটার পরিমাণ খুবই কম। কারণ এসব দেশের তুলনায় ভারতের পেঁয়াজ দ্রুত দেশে পৌঁছায় বলে গুণে-মানে ভালো থাকে। কিন্তু প্রশ্ন একটাই, কৃষি প্রধান দেশ হয়েও বাংলাদেশ কেন পেঁয়াজ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়? তবে ছয় বছরের পরিশ্রমেই পেঁয়াজের চাহিদা পুরোপুরি মেটানো সম্ভব বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
এরইমধ্যে দেশে মসলার উৎপাদন বাড়াতে গবেষণার ওপর জোর দিয়েছে সরকার। তাই সরকার মসলার উৎপাদন বৃদ্ধিতে গবেষণার জন্য একটি পৃথক প্রকল্প গ্রহণ করেছে। এটি হলো ‘বাংলাদেশ মসলা জাতীয় ফসলের গবেষণা জোরদারকরণ’। এ প্রকল্পের পরিচালক ড. শৈলেন্দ্রনাথ মজুমদার মসলা গবেষণা কেন্দ্রে পেঁয়াজ চাষের বিষয়গুলো দেখেন।
পেয়াঁজের ব্যাপারে ভারত কোনো সিদ্ধান্ত নিলে তার প্রভাব পড়ে দেশের বাজারে। ছবি: সংগৃহীত
ড. শৈলেন্দ্রনাথ মজুমদার বলেন, আমাদের পক্ষে পেঁয়াজ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়া সম্ভব। কৃষকদেরও আগ্রহ আছে। কিন্তু কিছু সমস্যা আছে। পেঁয়াজ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে হলে এই সমস্যাগুলোর সমাধান আগে করতে হবে। এর পেছনে কয়েকটি কারণ আছে; যেমন- বীজের অভাব, সমন্বিত চাষাবাদ না করা, দাম ওঠা-নামা, সংরক্ষণ ব্যবস্থা না থাকা, চরের জায়গা ব্যবহার না করা ও গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজে নজর না দেয়া।
যেভাবে পেঁয়াজ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারে বাংলাদেশ
পেঁয়াজ চাষাবাদে বীজের অভাব, সংরক্ষণ ব্যবস্থা, দাম নির্ধারণ—ইত্যাদির মাধ্যমে হয়তো একবছরেই রাতারাতি ঘাটতি পূরণ হবে না। তবে সঠিক নীতি ও পরিকল্পনা আর উদ্যোগ পাঁচ-ছয় বছরের মধ্যেই পেঁয়াজের ঘাটতি শূন্যে নামিয়ে নিয়ে আসতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাদেশের কৃষকদের জন্য পেঁয়াজের ভালো ও উন্নত বীজের অভাব রয়েছে। ড. শৈলেন্দ্রনাথ মজুমদার বলেন, আমাদের দেশে প্রতিবছর এক হাজার ১০০ টন পেঁয়াজের বীজের প্রয়োজন। এর মধ্যে পাঁচ-ছয় টন সরকারিভাবে এবং ৫০-৬০ টন পেঁয়াজ বীজ বেসরকারিভাবে উৎপাদিত হয়। বাকিটা কৃষকরা উৎপাদন করেন।
পেঁয়াজ উৎপাদন বাড়াতে হলে এই বীজের উৎপাদন এবং সংরক্ষণও বাড়াতে হবে। গত বছর এক মণ পেঁয়াজের দাম এক লাখ টাকায় বিক্রি হয়েছে; কিন্তু এ বছর দুই লাখ টাকা দিয়েও পাওয়া যাচ্ছে না। এর প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে সামনের বছরের উৎপাদনে।
পেয়াজের বীজের সহজলভ্যতা পেলে সমন্বিত চাষাবাদে জোর দিতে হবে। অন্যান্য ফসলের সঙ্গে, যেমন আখের ক্ষেতে, ভুট্টার ভেতর, আদা-হলুদের সঙ্গে পেঁয়াজ চাষ করা যায়। গরমের সময় কচুমুখীর ক্ষেতে চাষ করা যায়। এভাবে চাষ করলে ঘাটতি ১১ লাখ টন পেঁয়াজের চাহিদা পূরণের জন্য বাড়তি জমিরও প্রয়োজন হবে না।
চলতি বছরে দেশে পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছে ২৫ লাখ ৫৭ হাজার টন। ছবি: সংগৃহীত
ড. শৈলেন্দ্রনাথ বলেন, পেঁয়াজ চাষাবাদ বাড়ানোর ক্ষেত্রে আরেকটি বড় সমস্যা হলো এর দামের ওঠানামা। কখনো কৃষক চাষাবাদ করে লোকসানের মুখে পড়েন। আবার কখনো অতিরিক্ত দামের কারণে বীজ পেঁয়াজ বিক্রি করে দেন। গতবছর দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে অধিকাংশ কৃষক অক্টোবর মাসে তাদের পেঁয়াজ বীজ বিক্রি করে দিয়েছেন। ফলে অনেক কৃষক এই বছর বীজ খুঁজে পাচ্ছেন না। তাই পেঁয়াজের সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ একটি দাম নির্ধারণ করে দেয়া উচিত।
বাংলাদেশে সাধারণত শীতকাল পেঁয়াজ উৎপাদনের উপযোগী আবহাওয়া, এখন নতুন জাতের পেঁয়াজ গরমকালে উৎপাদন করা গেলেও সেগুলো বেশিদিন সংরক্ষণ করা যায় না। এছাড়া বৃষ্টিপাতের কারণে জমিতে পানি জমে পেঁয়াজ নষ্ট হয়ে পড়ে। পচনশীল এই পণ্যটি সংরক্ষণ করা জরুরি হলেও বাংলাদেশে পেঁয়াজের জন্য উপযুক্ত কোল্ড স্টোরেজের যথেষ্ট অভাব রয়েছে বলে জানান বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জহিরুদ্দিন।
আলু যে কোল্ড স্টোরেজে সংরক্ষণ করা হয়। সেখানে পেঁয়াজ সংরক্ষণ করা যায় না। কারণ পেঁয়াজ সংরক্ষণের জন্য কোল্ড স্টোরেজে আর্দ্রতা লাগবে ৬০ শতাংশ, তাপমাত্রা লাগবে আট ডিগ্রী থেকে ১২ ডিগ্রী সেলসিয়াস। আলুর কোল্ড স্টোরেজে এই মাত্রাটা ভিন্ন থাকে। রাজশাহীর কৃষক আসলাম হোসেন বলেন, পেয়াজ নষ্ট হয়ে যায়। একটু বৃষ্টি হলে জমিতে পানি ওঠে পচে যায়। রাখার জায়গারও অভাব। তাই লস হয় অনেক।
গবেষকরা বলছেন, বাংলাদেশে বিস্তীর্ণ চর এলাকা রয়েছে। সেসব জমি যদি পেঁয়াজ উৎপাদনে কাজে লাগানো যায়, তাহলেই পেঁয়াজের বাড়তি চাহিদার ১০ লক্ষ টনের পুরোটা উৎপাদন করা সম্ভব। তবে সেজন্য পেঁয়াজ উৎপাদনের সমস্যাগুলো সমাধান করতে হবে। তাহলেই কৃষকরা পেঁয়াজ চাষাবাদে আগ্রহী হবেন।
বাংলাদেশের কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউটের মসলা গবেষণা কেন্দ্র বর্তমানে পেঁয়াজের ছয়টি জাত অবমুক্ত করেছে। তার মধ্যে তিনটি জাত গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজের জাত। সেগুলোর ভেতর বারি-৫ এর ওপর গবেষণাকারীরা সবচেয়ে বেশি জোর দিচ্ছেন। মার্চ মাসে রোপণ করে জুন-জুলাই মাসে অথবা অগাস্ট মাসে রোপণ করে নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে এসব পেঁয়াজের ফসল পাওয়া যায়। এসব গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ চাষাবাদ করলে সেটা চাহিদা বড় একটি অংশ যোগান দিতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।