সংবাদ ডেস্ক :: দেশে বিভিন্ন আইন, তদারকি ও নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান থাকা সত্ত্বেও ইটভাটার দৌরাত্ম্য কমছে না। মালিকরা মানছেন না কোনো নিয়মকানুন; ক্রমেই বন উজাড়, কৃষির ক্ষতি ও দেশের ভূ-প্রকৃতি ধ্বংস করে মাটি পুড়িয়ে তৈরি করা হচ্ছে ইট। এতে ইটভাটার কালো ধোঁয়ায় বিপন্ন হচ্ছে পরিবেশ, বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি, কমছে চাষাবাদের জমি ও গাছ।

রাজধানীর আশপাশ ও বাইরে বিভিন্ন রাস্তার দুই পাশে যতদূর চোখ যায় দেখা যায় ইটভাটা। এসব ইটভাটায় কয়লার পাশাপাশি কাঠও পোড়ানো হয়। অথচ কাঠ পোড়ানো নিষিদ্ধ। ফসলি জমিতে লোকালয়ে এসব ইটভাটার চিমনির উচ্চতা কোনোটিরই ৬০ ফুটের বেশি নয়। অথচ চিমনি থাকতে হবে ১২০ ফুট লম্বা। ইটের ভাটার চিমনি থেকে নির্গত কালো ধোঁয়ায় ওইসব এলাকার বাসিন্দারা অতিষ্ঠ। এমনকি আশপাশের গাছ মরে যাচ্ছে। গাছের পাতা শুকিয়ে ঝরে পড়ছে।

পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের জরিপ অনুযায়ী, দেশে সাড়ে ছয় হাজারের বেশি ইটভাটা রয়েছে। কিন্তু উদ্বেগের বিষয়, এর ৯০ শতাংশই জ্বালানি ব্যবহার, ভাটা স্থাপন ও পরিবেশ-সংক্রান্ত বিধান মানছে না। বাংলাদেশ সেন্টার ফর অ্যাডভান্স স্টাডিজের হিসাবে বছরে এক হাজার ৭০০ কোটিরও বেশি ইট তৈরি হয় এবং এজন্য প্রয়োজন পড়ে পাঁচ হাজার আটশ কোটি টনেরও বেশি মাটি।

ইটভাটার প্রভাব সম্পর্কে চিকিৎসক ডা. আকতার উজ-জামান বলেন, ইটভাটার কারণে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের মানুষ শ্বাসকষ্ট ও চোখের রোগে বেশি আক্রান্ত হন।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের সমন্বয়কারী স্থপতি ড. ইকবাল হাবিব বলেন, গবেষণায় দেখা গেছে, ইটভাটা মাটি, পানি এবং জনস্বাস্থ্যের ব্যাপক ক্ষতি করছে। ইটভাটার ধোঁয়ায় যে কার্বন মনোঅক্সাইড থাকে তা বাতাসকে যেমন দূষিত করে, তেমনি গাছপালা এবং ফসলের ক্ষতি করে। ইটভাটার বর্জ্যে যে সালফার থাকে তা নদী বা জলাশয়কে দূষিত করে। এর ফলে আশপাশের নদী থেকে মাছসহ সব ধরনের জলজপ্রাণী এবং উদ্ভিদ বিলুপ্ত হয়ে যায়। ইটভাটার আগুনের প্রচন্ড তাপে ইটভাটার আশপাশের ফসলি জমি নিষ্ফলা হয়ে যায়। এমনকি পার্বত্য এলাকায় পাহাড়ও এখন ইটভাটার কারণে ঝুঁকির মুখে রয়েছে। আর ইটভাটার কারণে বাতাস দূষিত হওয়ায় মানুষ নানা রোগে আক্রান্ত হয়।

ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০১৩তে উল্লেখ আছে, ইটভাটায় ফসলি জমির উপরের মাটি (টপ সয়েল) ব্যবহার করলে প্রথমবারের জন্য দুই বছরের কারাদণ্ড ও ২ লাখ টাকা জরিমানা করা হবে। দ্বিতীয়বার একই অপরাধের জন্য ভাটা কর্তৃপক্ষকে ২ থেকে ১০ বছরের জেল এবং ২ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা করা যাবে। অনুমোদন না নিয়ে ইটভাটা স্থাপন করলে এক বছরের কারাদন্ড এবং ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা যাবে। কিন্তু এখনো আইন বাস্তবায়ন করতে পারেনি সরকার। ফলে ইটভাটার আগ্রাসনও বন্ধ করা যাচ্ছে না।

পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) সাধারণ সম্পাদক আবদুস সোবহান বলেন, ‘এখনো প্রায় ১২০০ ইটাভাটায় সরাসরি গাছ পোড়ানো হচ্ছে। ইটভাটায় জ্বালানি হিসেবে কাঠ ব্যবহারে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। ড্রাম চিমনিবিশিষ্ট ইটভাটা নিষিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও কীভাবে তা টিকে আছে, সেই প্রশ্ন আমরাও করি।’

আবদুস সোবহান আরো বলেন, ‘ইটভাটায় প্রযুক্তিগত পরিবর্তন অত্যন্ত জরুরি। ইট তৈরিতে ব্যবহার করা হচ্ছে ফসলি জমির উর্বর ও সারযুক্ত উপরিভাগের মাটি। এটা বন্ধে নিয়মিত মনিটরিং প্রয়োজন। ফসলি জমির মাটির উপরি অংশ কাটা অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে জমির ফলন স্বাভাবিকের চেয়ে অনেকাংশে কমে যাবে। এতে হুমকির মুখে পড়বে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা।’

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইটভাটার কারণে পরিবেশদূষণ, ভূমির উর্বরতা হ্রাস ও বন উজাড় হচ্ছে। কৃষিজমি দিন দিন কমছে। ইটভাটাতে মাটির জোগান দিতে ফসলের জমি অকেজো গর্তে পরিণত হচ্ছে। কেবল সমতল ভূমি নয়, কোথাও কোথাও পাহাড় পর্যন্ত কাটা হয় ইটভাটার মাটি জোগাড় করার জন্য। এমনকি ইট তৈরির জন্য কাঁচা মাটিও বিদেশে পাচার করা হচ্ছে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী বলেন, কৃষিজমি নষ্ট ও পরিবেশের ক্ষতি করে ইট তৈরি এবং উর্বর ফসলি জমির উপরের অংশ দিয়ে ইট বানানো বন্ধ করতে হবে। মাটির ইটের বিকল্প হিসেবে যেসব উপকরণ ও প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়েছে, তার ব্যবহার বাড়াতে হবে। সরকারের যেসব বিভাগ অবকাঠামো নির্মাণ ও তদারকির দায়িত্বে নিয়োজিত তাদেরকেও এ ব্যাপারে এগিয়ে আসতে হবে।

3 COMMENTS

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here