সংবাদ ডেস্ক :: ‘আর কি ফিরে পাবো রে, যারে হারায়েছি জীবনে’ বৈঠকী আসরের শেষ রাতে এ গান না হলে ভক্তকূলে পূর্ণতা আসে না। ভাব আর ভক্তিবাদে বিশ্বাসীরা এ গানেই নয়ন জলে বুক ভাসায়। একে অপরকে বুকে জড়িয়ে কান্নার আবেগে হারিয়ে যায় ভাব সাগরে।

প্রচার রয়েছে মায়ের লাশ দেখার পরেই বিলাপ সুরে গানটি রচনা করেছিলেন কবি গানের শ্রেষ্ঠ সাধক বিজয় সরকার। গানই তার ধর্ম ছিল, আর সে ধর্মের কেন্দ্রে ছিল আত্মা-পরমাত্মার ভজনলীলা। বাংলায় বিচ্ছেদ গানের শ্রেষ্ঠ গীতিকারও তিনি।
‘তুমি জানো নারে প্রিয়, তুমি মোর জীবনের সাধনা’ এমন শত শত গান রচনা করেছেন বিচ্ছেদের যাতনা থেকেই।

আজ (৪ ডিসেম্বর) কবিয়াল বিজয় সরকারের ৩২তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৮৫ সালের এ দিনে ভারতে পরলোকগমন করেন চারণকবি বিজয় সরকার। পশ্চিমবঙ্গের কেউটিয়ায় তাকে সমাহিত করা হয়। ১৯৭৬ সালের দিকে পরিবারবর্গ নিয়ে ওপার বাংলায় পাড়ি জমান এ সাধক কবি।

বিজয় সরকার ১৯০৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি নড়াইলের ডুমদি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা-মায়ের দেয়া নাম ছিল বিজয় কৃষ্ণ অধিকারী। ভক্তকূলের কাছে তিনি পাগল বিজয় নামেই পরিচিত।

জীবনের শেষ বেলা পর্যন্ত গান সাধনাতেই কাটিয়েছেন তিনি। তার জনপ্রিয় কয়েকটি গানের মধ্যে রয়েছে-‘এ পৃথিবী যেমন আছে, তেমনই ঠিক রবে, সুন্দর এই পৃথিবী ছেড়ে একদিন চলে যেতে হবে’, ‘পোষা পাখি উড়ে যাবে সজনী, একদিন ভাবি নাই মনে’, ‘তুমি জানো না রে প্রিয়, তুমি মোর জীবনের সাধনা’, ‘আষাঢ়ের কোন ভেজা পথে’ এবং ‘আর কি ফিরে পাবো রে’।
সাধক বিজয়ের বাবার নাম নবকৃষ্ণ বৈরাগী, মাতার নাম হিমালয় কুমারী। পিতামহের নাম গোপালচন্দ্র বৈরাগী। বিজয় সরকার স্থানীয় টাবরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াকালীন নেপাল বিশ্বাস নামে এক শিক্ষকের কাছে যাত্রাগানের উপযোগী নাচ, গান ও অভিনয় শেখেন।

প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার জন্য তিনি বেশ কয়েকটি স্কুল পরিবর্তন করেন। প্রায় সবখানেই তিনি এমন এক বা একাধিক শিক্ষক পান, যাদের কাছে তিনি গান শেখার সুযোগ পেয়েছিলেন। অল্প বয়সে বাবা-মাকে হারানোয় পড়ালেখা বেশি দূর এগোয়নি। দশম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেন তিনি।

বিজয় সরকার স্থানীয় স্কুলেও কিছুদিন শিক্ষকতা এবং নায়েবের কাজও করেন। পাশাপাশি তিনি নিয়মিত বিভিন্ন ধরনের লোক ও আধুনিক গান চর্চা করতে থাকেন। ১৯২৫ সালে তিনি গোপালগঞ্জের কবিয়াল মনোহর সরকারের কাছে কবিগান শেখেন। কিছুদিন পর তিনি রাজেন্দ্রনাথ সরকারের সংস্পর্শে আসেন এবং তার কাছেও কবিগানের তালিম নেন।

১৯২৯ সালে বিজয় সরকার নিজে একটি গানের দল করেন এবং কবিয়াল হিসেবে পরিচিতি ও জনপ্রিয়তা লাভ করেন। গান লিখে তিনি নিজেই সুর করতেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, জসীমউদ্দীন, আব্বাসউদ্দীন প্রমুখের সাক্ষাৎও পান জীবনের নানা সময়ে।

বিজয় সরকার প্রায় ৪০০ সখি সংবাদ ও ধুয়া গান রচনা করেন। এর মধ্যে কিছু কাজ বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রকাশিত হয়। তিনি বাংলা একাডেমি, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি এবং রেডিও-টেলিভিশনেও কবিগান পরিবেশন করেন।
বাংলাদেশ ও ভারতে তিনি আনুমানিক চার হাজার আসরে কবিগান পারিবেশন করেন। এছাড়া তিনি রামায়ণ গানও পরিবেশন করতেন।

বিজয় সরকারের পারিবারিক উপাধি ছিল বৈরাগী। তিনি বৈরাগী ত্যাগ করে অধিকারী উপাধি গ্রহণ করেন। তবে কবিয়াল হিসেবে খ্যাতি অর্জন করায় তিনি সরকার উপাধি পেয়ে পরিচিতি পান।

তার দুই স্ত্রী- বীণাপানি ও প্রমোদা অধিকারীর কেউই বেঁচে নেই। সন্তানদের মধ্যে কাজল অধিকারী ও বাদল অধিকারী এবং মেয়ে বুলবুলি অধিকারী ভারতের পশ্চিমবঙ্গে বসবাস করছেন।

দুই বাংলাতেই কবি বিজয় সরকারের গান সমান তালে মূল্যায়িত হচ্ছে। ২০১৩ সালে বাংলাদেশ সরকার তাকে মরণোত্তর একুশে পদক প্রদান করে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here