সংবাদ ডেস্ক :: বেসরকারি খাতে ঋণের চাহিদা বেড়েই চলেছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর-২০১৭) এ খাতে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ঋণ বিতরণ বেড়েছে এক লাখ ২২ হাজার কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রা ও মুদ্রা বিনিময় হার সংক্রান্ত ত্রৈমাসিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত বেসরকারি খাতে ঋণ বিতরণ হয়েছে সাত লাখ ৯৭ হাজার ৭৮৯ কোটি টাকা। ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর শেষে বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ছিল ছয় লাখ ৭৫ হাজার ১৩৯ কোটি টাকা। ফলে গত সেপ্টেম্বর মাসে এ খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৭ দশমিক ৮০ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের শুরুতে (জুলাই-২০১৭) ঋণ বিতরণের প্রবৃদ্ধি ছিল ১৬ দশমিক ৯৪ শতাংশ। গত অর্থবছর শেষে (জুন-২০১৭) ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল ১৫ দশমিক ৯৭ শতাংশ। আর ডিসেম্বর-২০১৭ পর্যন্ত এ খাতে ১৬ দশমিক ৩০ শতাংশ ঋণের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়।

প্রতিবেদনে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধিকে ইতিবাচক বলা হলেও দেশে মূল্যস্ফীতি ঊর্ধ্বমুখী হওয়ার আশঙ্কা করা হয়েছে। মূলত আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বৃদ্ধি এবং বিভিন্ন প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট দুর্যোগকে (বন্যা, হাওড় এলাকায় জলোচ্ছ্বাস, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের অনুপ্রবেশ) মূল্যস্ফীতির প্রধান কারণ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

এছাড়া আমদানি ব্যয় বেশি হওয়ায় বৈদেশিক লেনদেন ভারসাম্যের চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত ক্রমে কমছে এবং টাকার বিপরীতে ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় রফতানিকারকদের প্রতিযোগিতার সামর্থ্য বাড়বে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক ড. জায়েদ বখত বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘পদ্মা সেতুসহ সরকারের বড় কয়েকটি প্রকল্প বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থা তৈরি করেছে। আরও কয়েকটি বড় প্রকল্পের কাজ শুরু হতে যাচ্ছে। এছাড়া দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকায় এবং সুদ হার কম হওয়ায় দেশি উদ্যোক্তারা বিনিয়োগে আগ্রহী হচ্ছেন। এক কথায় দেশে বিনিয়োগের আবহ সৃষ্টি হয়েছে।’

প্রসঙ্গত, ২০০৯-১০ অর্থবছর বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল ২৪ দশমিক ২৪ শতাংশ, ২০১০-১১ অর্থবছরে ২৫ দশমিক ৮৪ শতাংশ, ২০১২-১৩ অর্থবছরে ১৯ দশমিক ৭২ শতাংশ, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ১০ দশমিক ৮৫ শতাংশ এবং পরের দুই অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি হয় ১২ দশমিক ২৭ শতাংশ।

২০১৩ সালের পর থেকে দেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে বেসরকারি খাতে মন্দাবাস্থার কারণে বেসরকারি খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। তবে ২০১৫ সালের শুরু থেকে দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরে আসলে বেসরকারি খাত আবার চাঙ্গা হতে থাকে। ২০১৫ সালের শুরুতে ঋণের প্রবৃদ্ধি ১৩ শতাংশ থাকলেও ডিসেম্বরে তা দাঁড়ায় ১৪ দশমিক ১৯ শতাংশে। আর ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে প্রবৃদ্ধি হয় ১৪ দশমিক ৮২ শতাংশ এবং  মার্চে প্রবৃদ্ধি দাঁড়ায় ১৫ দশমিক ১৬ শতাংশ।

জানা গেছে, তৈরি পোশাক, বিদ্যুৎ, সিমেন্ট, ওষুধ শিল্পে মূলধনী যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানি, খাদ্যপণ্য (চাল, গম, ভোজ্যতেল, চিনি, পেঁয়াজ) আমদানি করতে ঋণ দিচ্ছে ব্যাংক। এছাড়াও সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের জন্য প্রয়োজনীয় মালপত্র আমদানিতেও ঋণের চাহিদা বাড়ায় বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি বাড়ছে।

ব্যাংক কর্মকর্তাদের দাবি, শিগগিরই ৬ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা ঋণ নেবে বসুন্ধরা অয়েল অ্যান্ড গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড (বিওজিসিএল)। ফলে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি আরও বাড়বে। এ ঋণের ব্যবস্থা করছে ব্যাংক এশিয়া। সঙ্গে আছে অগ্রণী ব্যাংক ও বাংলাদেশ ইনফ্রাচট্রাকচার ফাইন্যান্স ফান্ড লিমিটেড (বিআইএফএফএল)। ঋণ সরবরাহের জন্য ইতোমধ্যে সরকারি-বেসরকারি খাতের ২০ ব্যাংককে চিঠিও দেওয়া হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহম্মদ শামস-উল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সুদ হার কম এবং ব্যাংকগুলোর কাছে পর্যাপ্ত তহবিল থাকায় বিনিয়োগের পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। ফলে উদ্যোক্তারা এখন ব্যাংকমুখী। তারা ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করছেন। তার প্রমাণ হলো সম্প্রতি এলসি খোলার হার বেড়েছে। এছাড়া সরকার বিনিয়েগের জন্য বিভিন্ন অবকাঠামো তৈরি করছে। আবার গ্যাস, বিদ্যুতের সমস্যাও সমাধান হচ্ছে।’

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) ঋণপত্র খোলার হার বেড়েছে ৮৮ শতাংশ। এই সময়ে ঋণপত্র নিষ্পত্তিও বেড়েছে ২০ শতাংশ। অবশ্য ঋণপত্রের বড় অংশই সরকারি প্রকল্পের মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির। এছাড়া বেসরকারি খাতে মূলধনী যন্ত্রপাতি, ভোগ্যপণ্য ও কাঁচামাল আমদানিও বাড়ছে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য গত নভেম্বরে এক হাজার ১৩৮ কোটি ডলারের ঋণপত্র খুলেছে বাংলাদেশ আণবিক শক্তি কমিশন।

এ প্রসঙ্গে রফতানিকারক সমিতির সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি ২০ শতাংশেরও বেশি হওয়া দরকার। ২০১৩ সালের শুরুতে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে তিন বছরেরও বেশি সময় বিনিয়োগ খরা চলছে। এখন অনেকেই বিনিয়োগ করতে চাচ্ছেন। তবে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও অবকাঠামো খাতের সমস্যাগুলো দ্রুত সমাধান করা প্রয়োজন।’

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here