আলোচিত কয়েকটি মামলার রায় 

 

সংবাদ ডেস্ক :: ২০১৭ সাল বিদায়ের পথে। এ সালে ষোড়শ সংশোধনী বাতিল, নারায়ণগঞ্জ ৭ খুন মামলা ও পিলখানা হত্যা মামলার রায়সহ বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মামলার রায় দেয়া হয়। উল্লেখযোগ্য কয়েকটি মামলার রায় তুলে ধরা হল।

ষোড়শ সংশোধনী বাতিল

উচ্চ আদালতের কোন বিচারপতি যদি সংবিধান লংঘন করেন কিংবা অসদাচরণের দায়ে অভিযুক্ত হন, তাহলে তাকে কিভাবে অপসারণ করা হবে সে বিষয়টি সংবিধানে সংশোধন করা হয়েছিল ২০১৪ সালে। সংবিধানের ১৬তম সে সংশোধনীতে বলা হয়েছিল বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে থাকবে। বিষয়টিকে চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট দায়ের করা হলে আদালত ১৬তম সংশোধনীকে বাতিল ঘোষণা করে। ৩ জুলাই সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে৷ এই সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারকদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ থাকলে তাঁকে অপসারণের ক্ষমতা জাতীয় সংসদকে দেয়া হয়েছিল৷ এই রায়ের ফলে সংবিধানে বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের হাতে ন্যাস্ত হয়, যার প্রধান হলেন প্রধান বিচারপতি৷

এই রায়ে বর্তমান সংসদকে অপরিপক্ক এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থারও সমালোচনা করা হয়৷ একই সঙ্গে সংবিধানের ১৬১ অনুচ্ছেদে বিচারকদের শৃঙ্খলা-বিধি নিয়েও কথা বলা হয়৷ প্রশ্ন তোলা হয় সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে, যেখানে সংসদ সদস্যদেরও দলের বিপক্ষে গিয়ে ভোট দেয়ার অধিকার খর্ব করা হয়৷

পিলখানা হত্যা মামলার রায়

২০০৯ সালের ২৫-২৬ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর পিলখানায় বিডিআর সদর দফতরে বিদ্রোহের ঘটনায় ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। এ ঘটনায় প্রথমে রাজধানীর লালবাগ থানায় হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দুটি মামলা হয়। পরে এসব মামলা নিউমার্কেট থানায় স্থানান্তরিত হয়। সিআইডি দীর্ঘ তদন্ত শেষে হত্যা মামলায় ২৩ বেসামরিক ব্যক্তিসহ প্রথমে ৮২৪ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করে। এ ছাড়া বিস্ফোরক আইনে করা মামলায় ৮০৮ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় সিআইডি। পরে আরও ২৬ জনকে অভিযুক্ত করে মোট ৮৩৪ জনের বিরুদ্ধে সম্পূরক অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। বিচার চলাকালে তৎকালীন বিডিআরের ডিএডি রহিমসহ চার আসামির মৃত্যু হয়।

রাজধানীর বকশীবাজার আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে স্থাপিত ঢাকার তৃতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক ড. মো. আখতারুজ্জামান ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর এ হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করেন। রায়ে ১৫২ জনকে মৃত্যুদণ্ড, ১৬০ জনকে যাবজ্জীবন, ২৫৬ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড এবং ২৭৮ জনকে খালাস দেওয়া হয়। আর ৪ জন আসামি বিচার চলাকালে মারা যাওয়ায় মামলার দায় থেকে তাদের অব্যাহতি দেওয়া হয়। রায়ে খালাসপ্রাপ্ত ৬৯ জন আসামির সাজা চেয়ে আপিল করে রাষ্ট্রপক্ষ। অন্যদিকে দণ্ড প্রাপ্ত ৪১০ জন আসামি তাদের সাজা বাতিল চেয়ে রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন।

বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে ২০১৫ সালের ১৮ জানুয়ারি হাইকোর্টে আপিলের শুনানি শুরু হয়। চলতি বছরের ২৭ নভেম্বর আপিলের রায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ১৫২ আসামির মধ্যে ১৩৯ জনের ফাঁসির রায় বহাল রেখেছেন হাইকোর্ট। আটজনের মৃত্যুদণ্ডের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন ও চারজনকে খালাস দেওয়া হয়েছে। এছাড়া পিন্টু নামে এক আসামির মৃত্যু হয়।

বিচারপতি মো. শওকত হোসেনের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বিশেষ হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রায় ঘোষণা করেন। বিশেষ এ বেঞ্চের অপর দুই সদস্য হলেন- বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী ও বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার। জজ আদালতে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ পাওয়া ১৬০ জনের মধ্যে ১৪৬ জনের সাজা বহাল রাখা হয়। আসামিদের মধ্যে দুজনের মৃত্যু হয়েছে এবং খালাস পায় ১২ আসামি। জজ আদালতে খালাস পাওয়া যে ৬৯ জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করেছিল, তাদের মধ্যে ৩১ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন হাইকোর্ট। এছাড়া সাত বছর করে চারজনকে কারাদণ্ড এবং ৩৪ জনের খালাসের রায় বহাল রাখা হয়।

নারায়ণগঞ্জ ৭ খুন মামলা

২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল দুপুরে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোড থেকে অপহৃত হন নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের তৎকালীন কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম, নজরুলের বন্ধু মনিরুজ্জামান স্বপন, তাজুল ইসলাম, লিটন, গাড়িচালক জাহাঙ্গীর আলম, আইনজীবী চন্দন সরকার ও চন্দন সরকারের গাড়িচালক মো. ইব্রাহীম। এরপর ৩০ এপ্রিল শীতলক্ষ্যা নদীতে একে একে ভেসে ওঠে ছয়টি লাশ। পরদিন হদিস মেলে আরেকটি লাশের। পুরো দেশেই তখন ঘটনাটি আলোচিত হয়ে ওঠে। ঘটনার একদিন পর নিহত হওয়া কাউন্সিলর নজরুলের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বাদী হয়ে নূর হোসেনসহ ছয়জনের নাম উল্লেখ করে ফতুল্লা মডেল থানায় মামলা করেন। আইনজীবী চন্দন সরকার ও তাঁর গাড়িচালক ইব্রাহিম হত্যার ঘটনায় ১১মে ফতুল্লা থানায় আরেকটি মামলা হয়। বাদী চন্দন সরকারের জামাতা বিজয় কুমার পাল। পরে দুটি মামলা একসঙ্গে তদন্ত করে পুলিশ।

একসঙ্গে সাতজনকে ঠান্ডা মাথায় হত্যা ও গুমের নৃশংসতায় শিউরে ওঠে মানুষ। টক অব দ্যা কান্ট্রিতে পরিণত হয়। ঘটনার রেশ না কাটতেই খবর বের হয়, হত্যায় র‍্যাব-১১-এর অধিনায়ক তারেক সাঈদসহ তিন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জড়িত। এ খবর সারা দেশের মানুষকে হতবাক ও উদ্বিগ্ন করে। কোটি টাকার বিনিময়ে সাতজনকে অপহরণের পর হত্যার অভিযোগ ওঠে তাদের বিরুদ্ধে। র‌্যাবের তিন কর্মকর্তাকে নিজস্ব বাহিনীতে ফেরত নিয়ে চাকরিচ্যুত করা হয়। এরপর র‌্যাবের এই তিন কর্মকর্তাকে আটক করে কেন জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে না এবং তাঁদের বিরুদ্ধে কেন মামলা নেওয়া হবে না এই বিষয়ে নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে রিট করেন নারায়ণগঞ্জ জেলা আইনজীবী সমিতির তৎকালীন সভাপতি সাখাওয়াত হোসেন, আইনজীবী মাহবুবুর রহমান ইসমাইল ও চন্দন সরকারের মেয়ের জামাতা বিজয় কুমার পাল।

হাইকোর্টে রিটের পক্ষে শুনানি করেন বিশিষ্ট আইনজীবী ড. কামাল হোসেন। ২০১৪ সালের ১১মে মামলার শুনানি শেষে হাইকোর্ট চাকরিচ্যুত র‍্যাবের তিন কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করে জিজ্ঞাসাবাদ করার আদেশ দেন। ছয় দিন পর ২০১৪ সালের ১৬মে ঢাকার সেনানিবাস থেকে চাকরিচ্যুত লে. কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদ ও মেজর আরিফ হোসেন এবং পরদিন লে. কমান্ডার এম এম রানাকে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার ও রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তাঁরা পরে ঘটনায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দেন।

তিন কর্মকর্তার জবানবন্দিতে র‌্যাব-১১-এর অন্যান্য সদস্য ও কর্মকর্তার সম্পৃক্ততার বিষয় উঠে এলে পর্যায়ক্রমে তাঁদেরও গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর অন্য র‍্যাব সদস্যরাও আদালতে জবানবন্দি দেন। মোট ২১জন আসামি দায় স্বীকার করেন এবং হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দিয়ে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। সাক্ষী হিসেবে র‌্যাবের ১৪ জনসহ ২০ জন আদালতে জবানবন্দি দেন। আদালতে সাক্ষ্য দেন ১০৬ জন সাক্ষী।

২০১৬ সালের ১৬ জানুয়ারি আলোচিত ৭ খুন মামলার রায়ে কাউন্সিলর নুর হোসেন এবং সাবেক র‍্যাব অধিনায়ক তারেক সাঈদসহ ২৬ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। হত্যাকাণ্ডের প্রায় তিন বছর পর দেয়া রায়ে ৩৫ জন আসামীর বাকিদের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেয় নারায়নগঞ্জের একটি আদালত।

চাঞ্চল্যকর সাত খুন মামলায় ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন) ও আপিলের ওপর হাইকোর্ট রায় দেয় চলতি বছরের ২২ আগস্ট। রায়ে ১৫ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন আদালত। ১১ জনের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং বিভিন্ন মেয়াদে সশ্রম কারাদণ্ডপ্রাপ্তদের সাজাও বহাল রাখেন আদালত। বহাল রাখা মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত আসামীদের মধ্যে নুর হোসেন ও তারেক সাঈদও রয়েছেন।

বিশ্বজিৎ হত্যা মামলার পূর্ণাঙ্গ রায়

চলতি বছরের ৩১ অক্টোবর পুরনো ঢাকার বহুল আলোচিত দর্জি বিশ্বজিৎ দাস হত্যা মামলায় হাইকোর্টের রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ হয়। রায়ে বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া আট আসামির মধ্যে দুই জনের মৃত্যুদণ্ড, চারজনের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন ও দুইজনকে খালাস দেওয়া হয়। রায় প্রদানকারী বিচারপতি মো. রুহুল কুদ্দুস ও বিচারপতি ভীষ্মদেব চক্রবর্তী পূর্ণাঙ্গ রায় লেখা শেষে স্বাক্ষরও করেন। ৮০ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়টি স্বাক্ষরের পর তা প্রকাশের জন্য সংশ্লিষ্ট শাখায় পাঠানো হয়। এর আগে গত ৬ আগস্ট দর্জি দোকানি বিশ্বজিৎ দাস হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ড পাওয়া আট আসামির মধ্যে দু’জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে রায় ঘোষণা করেন হাইকোর্ট। বাকি ছয় জনের মধ্যে চার জনের মৃত্যুদণ্ড কমিয়ে যাবজ্জীবন এবং অন্য দু’জনকে খালাস দেয় আদালত।

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here