অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, স্বাস্থ্যসেবা, পথ্য, শিক্ষা সরঞ্জাম, পানি, বিদ্যুৎ, যানবাহনসহ মানুষের প্রয়োজনীয় উপাদানের কী না দিচ্ছে মাটি? নিঃস্বার্থভাবে সবকিছুরই জোগান দিয়ে যাচ্ছে এ শীতল ভূমি। আর আমরা সে মাটিকে দূষিত করে চলছি বিভিন্নভাবে। আমাদের কলকারখানার বর্জ্য, বালাইনাশক, আগাছানাশক, হাসপাতালের বর্জ্য, ইটভাটার ছাইসহ নানা বর্জ্য মাটির বুকে ঢালছি। একটুও কি ভেবেছি, এতে মাটির কতটা কষ্ট হতে পারে
মাটি বা মৃত্তিকা হলো পৃথিবীর উপরিভাগের নরম ও দানাদার আবরণের নামÑ যার ওপর ভর করে দাঁড়িয়ে আছে আকাশছোঁয়া পাহাড়, সবুজের বাগান। তারই বুক চিরে বয়ে যায় ছলাৎ-ছলাৎ স্রোতধারা। হেঁটে যায় মানুষসহ আরও কত শত প্রাণী; রেখে যায় তাদের পদছাপ। কারণ তারা এ মাটিরই সন্তান, বিশেষ করে মানুষ। মানুষ তো এ মাটিরই গড়া। মাটির ওপরই মানুষের জীবনযাপন। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তিনি তোমাদের মৃত্তিকা থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং তাতেই তোমাদের আবাসনের ব্যবস্থা করেছেন।’ (সূরা হুদ : ৬১)। বেলা শেষে আবার এ মাটির কোলেই নিতে হয় অনন্তকালের আশ্রয়। যেমনটি বলা হয়েছে পবিত্র কোরআনের অপর এক জায়গায়, ‘তিনিই তোমাদের জন্য মাটিকে ব্যবহারের উপযোগী করে দিয়েছেন। সুতরাং তোমরা এর দিকে বিচরণ করো এবং তার দেয়া রিজিক আহার করো, পুনরুত্থান তারই কাছে হবে।’ (সূরা মুলক : ১৫)।
সুতরাং মাটি আমাদের, আমরা মাটির। মানবজাতির আদি পিতা হজরত আদম (আ.) থেকে শুরু করে পৃথিবীর সর্বশেষ মানুষটিও এ মাটিরই সৃষ্টি। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তিনি মানবজাতিকে সৃষ্টি করেছেন পোড়ামাটির মতো শুষ্ক মৃত্তিকা থেকে।’ (সূরা রহমান : ১৪)। এই যে পৃথিবীর একেক প্রান্তের মানুষজন একেকে রকমের, এর পেছনেও রয়েছে মাটিরই মাহাত্ম্য। এ প্রসঙ্গে একটি বহুল পরিচিত হাদিসও রয়েছে। নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহ তায়ালা পৃথিবীর সব অংশের মাটি জমা করে তা দিয়ে হজরত আদম (আ.) কে সৃষ্টি করেন। অতঃপর আদমসন্তান পৃথিবীতে বসবাস শুরু করে। আদমসন্তানদের মাঝে কেউ গৌরবর্ণ, কেউ কৃষ্ণবর্ণ, কেউ নম্র স্বভাব, কেউ শক্ত স্বভাব, কেউ ভালো, কেউ মন্দ।’ (তিরমিজি : ২৫৬৩)।
হজরত আদম (আ.) জান্নাত থেকে নেমে এ মাটিতেই স্বপ্নের চারা বুনেছিলেন। মাটিতে বেঁধেছিলেন সুখের ঘর। জীবনধারণের জন্য তাঁর প্রধান কাজ ছিল কৃষি কাজÑ মানে মাটির সঙ্গে মাখামাখি। এ মাখামাখি তিনি একা নন, করেছেন পৃথিবীতে আগত প্রত্যেক নবী-রাসুলরাই। এমনকি আমাদের নবীজিও (সা.) ছিলেন এ মাটিরই সেবক। হাদিস থেকে জানা যায় রাসুল (সা.) ‘জারেক’ নামক স্থানে কৃষি ফসলাদি উৎপাদন করতেন। তাছাড়া তিনি বাল্যকালে পাহাড়ের পাদদেশে মেষপাল চরিয়েছেন। নিজ হাতে খেজুর গাছ রোপণ করেছেন। সাহাবিদের কৃষি কাজে উৎসাহিত করেছেন। আর বলেছেন, ‘তোমরা জমি আবাদ করো। কেউ যদি নিজে আবাদ করতে না পারে, সে যেন ভূমিটি অন্য ভাইকে দিয়ে দেয়, যাতে সে আবাদ করে ভোগ করতে পারে।’ (মুসলিম : ৭১)।
পবিত্র কোরআনেও কৃষি উৎপাদনকে আখ্যায়িত করা হয়েছে বিশ্বমানবের প্রতি একটি বিরাট অনুগ্রহ বলে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘মানুষ তার খাদ্যের প্রতি লক্ষ করুক, আমি আশ্চর্য উপায়ে পানি বর্ষণ করেছি। এরপর মাটিকে বিদীর্ণ করেছি। অতঃপর তাতে উৎপন্ন করেছি শস্য, আঙুর, শাকসবজি, জয়তুন, খেজুর, ঘন উদ্যান, ফল এবং ঘাস তোমাদের ও তোমাদের চতুষ্পদ জন্তুদের উপকারার্থে।’ (সূরা আবাসা : ২৪-৩২)।
এই যে এত এত কোদালের কোপ, লাঙলের ঘা, শাবলের গুঁতোয় ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে মাটির দেহাঙ্গ, মাটি কি কোনোদিন এর প্রতিবাদ করেছে? টুঁ শব্দটিও তো করে না। বরং আমাদের সব আঘাত নীরবে সহ্য করে যায়। আর মায়ের মতো মুখে তুলে দেয় নানা খাবার। তাই তো কোনো এক কবি বলে গেছেনÑ ‘যার বুকে তুই জন্ম নিলি তারে চিনলি না। মাটির মঙ্গল করো রে ভাই মাটি যে তোর মা।’
অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, স্বাস্থ্যসেবা, পথ্য, শিক্ষা সরঞ্জাম, পানি, বিদ্যুৎ, যানবাহনসহ মানুষের প্রয়োজনীয় উপাদানের কী না দিচ্ছে মাটি? নিঃস্বার্থভাবে সবকিছুরই জোগান দিয়ে যাচ্ছে এ শীতল ভূমি। আর আমরা সে মাটিকে দূষিত করে চলছি বিভিন্নভাবে। আমাদের কলকারখানার বর্জ্য, বালাইনাশক, আগাছানাশক, হাসপাতালের বর্জ্য, ইটভাটার ছাইসহ নানা বর্জ্য মাটির বুকে ঢালছি। একটুও কি ভেবেছি, এতে মাটির কতটা কষ্ট হতে পারে! এ উপলব্ধি থেকেই জাতিসংঘের ৬৮তম সাধারণ সভায় ২০১৫ সালকে ‘আন্তর্জাতিক মৃত্তিকা বর্ষ’ হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন। একই সঙ্গে ১৫ ডিসেম্বরকে ‘বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস’ বলেও ঘোষণা দেয়া হয়। এ ঘোষণার প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে, ‘সুস্বাস্থ্যের জন্য স্বাস্থ্যবান মাটি।’ এ প্রসঙ্গে জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব বান কি মুন বলেন, ‘স্বাস্থ্যবান মাটি ছাড়া এ পৃথিবীতে মানব জীবন টেকসই হবে না।’ তাই মাটির স্বাস্থ্যের দিকে নজর রাখা প্রতিটি মানুষেরই আবশ্যিক কর্তব্য। কেন না দূষিত মাটি দ্বারা মানুষেরই সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়ে থাকে। চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা বলেন, ‘মানুষ নানাভাবে দূষিত মাটির সংস্পর্শে আসার কারণে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়। উল্লেখযোগ্য রোগগুলোর মধ্যে রয়েছে ক্যান্সার, কিডনি ও লিভারের সমস্যা, ম্যালেরিয়া, কলেরা, আমাশয়, চর্ম ও পাকস্থলীর সংক্রমণ।
তাই আমাদের উচিত মাটিকে মায়ের মতো ভালোবাসা। মাটিদূষণের প্রতিবাদ করা। প্রতিরোধ করা। পাশাপাশি মাটির উৎপাদিকা শক্তি, খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টি সম্পর্কে গণসচেতনতা বৃদ্ধি করা। মাটির পাশাপাশি আরও যত প্রাকৃতিক সম্পদ আছে সবকিছুর যথাযথ ব্যবহার, পরিচর্যা ও সংরক্ষণ করে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা। কারণ পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা না করলে মানবসভ্যতায় নেমে আসবে প্রাকৃতিক বিপর্যয়।
লেখক : ইমাম ও খতিব, বাইতুল আমান
জামে মসজিদ, বাঙ্গরা, কুমিল্লা