সংবাদ ডেস্ক :: ঝিনাইদহ থেকে ২ বছরের মেয়ে লামিসাকে নিয়ে রাজধানীর জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে এসেছেন তার মা আয়েশা। জন্ম থেকেই মেয়েটির হৃদপিণ্ডে ছিদ্র। তাই প্রায়ই জ্বর আসতো, ঠিকভাবে খেতেও পারতো না। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসকের পরামর্শে তাকে ঢাকায় নিয়ে আসেন আয়েশা। গত ২১ নভেম্বর লামিসার হৃদপিণ্ডে বোতাম বসানো হয়েছে। সে এখন আগের চেয়ে কিছুটা সুস্থ বোধ করছে বলে জানান তার মা। স্বাভাবিক খাবারও খেতে পারছে মেয়েটি।
একই রকম রোগাক্রান্ত ছিল ১০ বছরের সুইটি। তার বাবার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দীর্ঘদিন ধরে মেয়েটির জ্বর ও ঠাণ্ডা ছিল। কখনও জ্বর ছাড়িয়ে যেতো ১০৩ ডিগ্রির ঘর। অনেক জায়গায় চিকিৎসার জন্য গিয়েও লাভ হয়নি। পরে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের কথা জেনে চট্টগ্রামের মিরসরাই থেকে তাকে নিয়ে আসেন বাবা-মা। তবে তিনি জানতে পারেন এখানকার চিকিৎসা ব্যয়বহুল। তবে চিকিৎসকরা জানালেন, ঘাবড়ানোর কিছু নেই। সব দায়িত্ব তাদের। দুই ঘণ্টাব্যাপী ইন্টারভেশনের পর সুইটি এখন কিছুটা সুস্থ।
জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের একদল চিকিৎসক এভাবেই কাঁটাছেড়া না করে সবকিছু ঠিক রেখে হার্টের বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা সেবা দিয়ে আসছেন দীর্ঘদিন ধরে। দেশে এখন আধুনিক ব্যবস্থাপনায় উন্নত প্রযুক্তিতে শল্যচিকিৎসা করে শিশুদের হৃদরোগ নিরাময় করা হচ্ছে। শিশুদের জন্মগত হৃদরোগ যেমন— এএসডি, ভিএসডি, পিডিএ, টিজিএ ইত্যাদির শল্যচিকিৎসা এখন দেশেই মিলছে।
ছোটদের হৃদরোগের চিকিৎসায় সার্জারিতে মৃত্যুঝুঁকি থাকে বলেই এখন শল্যচিকিৎসা বেশ জনপ্রিয়। হার্টের ছিদ্র, জন্মগত বাড়তি নালি, রক্তনালীর সংকুচিত অংশ কিংবা সংকুচিত বাল্বের চিকিৎসার জন্য এখন আর সার্জারির প্রয়োজন হয় না। বর্তমান আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থায় সার্জন ও কার্ডিওলজি বিশেষজ্ঞের তত্ত্বাবধানে জন্মগত হৃদরোগের কাঁটাছেড়াহীন চিকিৎসা এখন দেশেই সম্ভব হচ্ছে।
শিশুর টফের যে অংশে বাল্ব সংকুচিত অবস্থায় থাকে বিশেষজ্ঞরা তা ঠিক করে থাকেন বেলুন চিকিৎসার মাধ্যমে। হাইব্রিড প্রটোকলের মাধ্যমে হৃদপিণ্ডের ছিদ্র মেরামতসহ অন্যান্য শল্যচিকিৎসা করেন সাধারণত সার্জনরা। এই অভিনব ব্যবস্থাপনার চিকিৎসা শিশু হৃদরোগ নিরাময়ে যুগান্তকারী রূপ নিয়েছে। হৃদপিণ্ডে জন্মগত ছিদ্র এমপ্লাঞ্জার বা বোতাম ডিভাইসের মাধ্যমে বন্ধ করা সম্ভব। আবার ধমনি সংকুচিত রোগের ক্ষেত্রে নালির মধ্যে স্টেন্ট কিংবা রিং বসিয়ে শিশুকে সুস্থ রাখা যায়।
জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে এ পদ্ধতিতে এখন পর্যন্ত চিকিৎসা নিয়েছেন প্রায় ৫৫০ জন। বিদেশি চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে প্রায়ই ওয়ার্কশপের আয়োজন করা হয় এখানে। গত ২১ ও ২২ নভেম্বর তেমনই এক ওয়ার্কশপে হৃদরোগের চিকিৎসা নিয়েছেন ১০ শিশু। সম্পূর্ণ বিনামূল্যে এই চিকিৎসার ব্যয়বহন করছে খুরশিদা মেমোরিয়াল ট্রাস্ট। এখানে চীনের হুয়াই হসপিটালের প্রখ্যাত শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ হু হাই বো দুই দিন বিনামূল্যে সেবা দিয়েছেন। প্রতিটি ডিভাইসের মূল্য ১.৫ থেকে ২ লাখ টাকা।
জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের শিশু কার্ডিওলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. আবদুল্লাহ শাহরিয়ার বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, এই ব্যয় গরিব রোগীদের বহন করা কষ্টসাধ্য হয়ে দাঁড়ায় বলেই ওয়ার্কশপের আয়োজন। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেছেন, ‘আমাদের লক্ষ্য একটাই, দেশে উন্নতমানের চিকিৎসা। রোগীদের যেন এজন্য বিদেশে যেতে না হয়। বিনা চিকিৎসায় কোনও শিশু যেন মারা না যায় সেই লক্ষ্যে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের চাওয়া, বিদেশি চিকিৎসকরা এভাবে নিয়মিত আসবেন।’
ডা. শাহরিয়ার আরও বলেন, ‘ইন্টারভেশন পদ্ধতিতে আমরা সহজেই ক্যাথল্যাবে শিশুদের হৃদরোগের চিকিৎসা দিতে পারি। কিন্তু এটি ব্যয়বহুল, তাই সমাজের বিত্তশালীদের এগিয়ে আসার জন্য আহ্বান জানাই। তাহলে আমরা পরিকল্পিতভাবে গরিব রোগীদের স্বাস্থ্যসেবা পরিচালনা করতে পারবো।’
চ্যারিটির ফাঁকে অনেকে ব্যবসায়ী মনোভাব নিয়ে কাজ করতে চায়, এ প্রসঙ্গে জানতে চাওয়া হলে এই শিশু বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘হ্যাঁ, কিছু অসাধু ব্যক্তি চ্যারিটির কাজের ফাঁকে ব্যবসায়িক রাস্তা খুঁজে নেন এটা সত্যি। এজন্য বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলকে (বিএমডিসি) শক্তভাবে বিষয়টি তদারকির অনুরোধ করবো।’
বিশেষজ্ঞরা জানান— শিশু ও প্রাপ্তবয়স্কদের হৃদরোগের কারণ ও উপসর্গ ভিন্ন। তাই চিকিৎসাও ভিন্ন। ওষুধের মাধ্যমে বড়দের হৃদরোগ প্রাথমিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা গেলেও ছোটদের জন্মগত হৃদরোগের ক্ষেত্রে এই পন্থা কাজে আসে না বলে মনে করেন তারা। এজন্য বেছে নিতে হয় শল্যচিকিৎসা। উন্নত বিশ্বের মতো বাংলাদেশের চিকিৎসকরাও এখন এই পথ বেছে নিচ্ছেন।
বাংলাদেশে প্রতি ১ হাজার শিশুর মধ্যে ৮-১০ জন হৃদরোগে ভুগছে। তাদের বেশিরভাগই জন্মগত কারণে কিংবা জন্মের পরপরই হৃদরোগী হয়ে যায়। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশে শতকরা প্রায় ২৭ ভাগ মানুষের মৃত্যু হয় করোনারি হৃদরোগের কারণে। এর মধ্যে মৃত্যুবরণ করা শিশুদের ১০ ভাগই হৃদরোগী।
হৃদরোগে শিশু মৃত্যুর হার পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, দেশে এর পর্যাপ্ত চিকিৎসা ব্যবস্থার অভাবই এর মূল কারণ। শহরের চেয়ে গ্রামাঞ্চলে এই সমস্যা প্রকট। মফস্বলে কার্ডিওলজি বিশেষজ্ঞ তুলনামূলকভাবে কম আর প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির অভাবে এ ধরনের চিকিৎসাসেবা হয়ে পড়েছে শহরকেন্দ্রিক।