সংবাদ ডেস্ক :: সাধারণ গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম আবারও বাড়ল গড়ে ৫ দশমিক ৩ শতাংশ, ইউনিটপ্রতি ৩৫ পয়সা। বর্ধিত দাম আগামী মাস, অর্থাৎ ডিসেম্বর থেকেই কার্যকর করা হবে বলে ঘোষণা দিয়েছে এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন বা বিইআরসি। গতকাল বৃহস্পতিবার কারওয়ান বাজারে কমিশনের কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে দাম বাড়ানোর এ ঘোষণা দেওয়া হয়। এর ফলে জানুয়ারি থেকেই বাড়তি বিল গুনতে হবে ভোক্তাকে। সার্বিক জনজীবন ও অর্থনীতিতেও এর বিরূপ প্রভাব পড়বে বলে মনে করছেন বিশ্নেষকরা। বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রতিবাদে কয়েকটি বাম সংগঠন ৩০ নভেম্বর বৃহস্পতিবার সারাদেশে সকাল ৬টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত হরতাল ডেকেছে। সংগঠনগুলো হলো- বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ) ও গণতান্ত্রিক বাম মোর্চা। বিএনপিও দাম প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে সরকারের এ সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছে। তবে গতকাল পর্যন্ত তারা কোনো কর্মসূচি ঘোষণা করেনি।
দুই বছর পর বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলো। সর্বশেষ ২০১৫ সালের ১ সেপ্টেম্বর বিদ্যুতের দাম গড়ে ২ দশমিক ৯৩ শতাংশ বাড়ানো হয়েছিল। ২০১০ সাল থেকে এ পর্যন্ত মোট আট দফা বাড়ল বিদ্যুতের দাম। এবার দাম বাড়ানো হয়েছে কেবল সাধারণ গ্রাহক পর্যায়ে। পাইকারিতে দাম বাড়ানো হয়নি, বরং ইউনিটপ্রতি ছয় পয়সা করে কমানো হয়েছে।
এবার দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে দরিদ্র গ্রাহকদের প্রতি সদয় আচরণ করেছে বিইআরসি। সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, খুচরা পর্যায়ে গড়ে ৫ দশমিক ৩ শতাংশ দাম বাড়ানো হলেও বিদ্যুতের নূ্যনতম চার্জ প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে। ফলে প্রতি মাসে যারা ৫০ ইউনিটের কম ব্যবহার করেন, এমন প্রায় ৩০ লাখ গ্রাহকের (মোট গ্রাহকের ১৩ শতাংশ) বিদ্যুৎ বিল কমবে। এই দাম বৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের প্রায় ৬০ লাখ গ্রাহকের (মোট গ্রাহকের ৩৮ শতাংশ) মাসিক বিল মোটেও বৃদ্ধি পাবে না।
কত বাড়ল :আবাসিক খাতসহ বিভিন্ন শ্রেণিতে ৫ থেকে ৭ দশমিক ২১ শতাংশ পর্যন্ত দাম বাড়ানো হয়েছে। বেড়েছে কৃষি, ক্ষুদ্রশিল্প এবং বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের বিদ্যুতের দামও। সেচে বিদ্যুতের দাম ইউনিটপ্রতি তিন টাকা ৮২ পয়সা থেকে বাড়িয়ে চার টাকা করা হয়েছে। ক্ষুদ্রশিল্প প্রতিষ্ঠানের বিদ্যুতের দাম অফপিক ছয় টাকা ৯০ পয়সা থেকে বাড়িয়ে সাত টাকা ৩৮ পয়সা, পিক সময়ে নয় টাকা ২৪ পয়সা থেকে বাড়িয়ে নয় টাকা ৮৪ পয়সা করা হয়েছে। আর ফ্ল্যাট রেটের ক্ষেত্রে সাত টাকা ৬৬ পয়সা থেকে বাড়িয়ে আট টাকা ২০ পয়সা করা হয়েছে। বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে আগের ফ্ল্যাট রেট নয় টাকা ৮০ পয়সার স্থলে করা হয়েছে ১০ টাকা ৩০ পয়সা, অফপিক সময়ের আট টাকা ৪৫ পয়সার স্থলে নয় টাকা ২৭ পয়সা এবং পিক সময়ের জন্য ১১ টাকা ৯৮ পয়সার স্থলে ১২ টাকা ৩৬ পয়সা দর নির্ধারণ করা হয়েছে। এ ছাড়া মধ্যচাপ শ্রেণির, অর্থাৎ ৫০ কিলোওয়াট থেকে ৫ মেগাওয়াট, উচ্চচাপ ৫ থেকে ৩০ মেগাওয়াট এবং অতি উচ্চচাপ ২০ থেকে সর্বোচ্চ ১৪০ মেগাওয়াট ব্যবহারকারীদের জন্যও দর পুনর্নির্ধারণ করা হয়েছে।
প্রতিক্রিয়া :বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির বিষয়ে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) সভাপতি সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন। তিনি সমকালকে বলেন, চলতি বছর গ্যাসের দাম বাড়ায় এক দফা পণ্য উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে। সামনে এলএনজি আসছে। তখনও আবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হবে। তাই এ সময়ে বিদ্যুতের দাম না বাড়ানোই যৌক্তিক ছিল।
গার্মেন্ট শিল্প মালিকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ভারতের পোশাক খাতে তাদের সরকার নানা ধরনের সহযোগিতা দিচ্ছে। দেশটির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়ছে। এর মধ্যে এ বছর দুই দফা গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে। এখন বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলো, যা পণ্যের উৎপাদন ব্যয় অনেক বাড়িয়ে দেবে। ব্যবসায়ীরা প্রতিযোগিতায় টিকতে পারবেন না।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম বলেন, এর ফলে নির্দিষ্ট আয়ের মানুষের জীবন-ব্যয় বাড়বে। বিভিন্ন নিত্যপণ্যের দাম বাড়বে। শিল্পপণ্যের উৎপাদন খরচ বাড়বে, যা মুদ্রাস্ম্ফীতিও বাড়িয়ে দেবে।
ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, গণশুনানিতে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির যৌক্তিকতা প্রমাণিত হয়নি। তারপরও কমিশন বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে গ্রাহকের স্বার্থের পরিপন্থী কাজ করেছে।
সিএনজি ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ফারহান নূর বলেন, বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির ফলে তাদের প্রফিট মার্জিন কমে যাবে।
কমিশনের ব্যাখ্যা :পাইকারি না বাড়িয়ে গ্রাহক পর্যায়ে দাম বৃদ্ধি কেন- জানতে চাইলে কমিশন চেয়ারম্যান মনোয়ার ইসলাম বলেন, বিতরণ খরচ বৃদ্ধি বিবেচনায় কমিশন এই দাম বাড়িয়েছে। সব শ্রেণির গ্রাহকের ওপর আর্থিক চাপ কমাতে এবার পাইকারি বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়নি। তিনি বলেন, ২০১৫ সালের তুলনায় এবার পাইকারিতে প্রতি ইউনিটে বিদ্যুতের দাম ছয় পয়সা করে কমানো হয়েছে। বিদ্যুতের নূ্যনতম চার্জ প্রত্যাহার করা হয়েছে। ফলে মাসে ৫০ ইউনিটের কম ব্যবহার করেন, এমন প্রায় ৩০ লাখ গ্রাহকের বিদ্যুৎ বিল কমবে। আর পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের প্রায় ৬০ লাখ গ্রাহকের মাসিক বিল মোটেও বৃদ্ধি পাবে না। বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, এ ধরনের গ্রাহকশ্রেণি আগে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ ব্যবহার করুক না কেন, আরইবি এলাকায় হলে নূ্যনতম ৯০ টাকা এবং অন্য বিতরণ এলাকার জন্য ১০০ টাকা ডিমান্ড চার্জ দিতে হতো। এখন ডিমান্ড চার্জ ২৫ টাকার সঙ্গে ব্যবহূত বিদ্যুতের বিল দিতে হবে।
কমিশনের সদস্য মিজানুর রহমান বলেন, বিতরণ কোম্পানিগুলোর বিদ্যুতের দাম নির্ধারণের জন্য এনার্জি কস্ট ও বিতরণ ব্যয় বিবেচনা করা হয়েছে। বিতরণ কোম্পানিগুলো গ্রাহকের আঙিনায় বিদ্যুৎ পৌঁছে দিতে গড়ে ছয় টাকা ৮৪ পয়সা পর্যন্ত খরচ করে। কিন্তু বিতরণ কোম্পানিগুলো প্রতি ইউনিটে এখন ছয় টাকা ৫০ পয়সা রাজস্ব আদায় করছে। এতে তাদের প্রতি ইউনিটে ৩৫ পয়সা লোকসান হচ্ছে। কমিশন এবার এই ৩৫ পয়সাই বৃদ্ধি করেছে।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, দাম বৃদ্ধির ফলে এই অর্থবছরে কোম্পানিগুলো অতিরিক্ত এক হাজার ৭০০ কোটি টাকা বেশি আয় করতে পারবে। এবার পাইকারি বিদ্যুতের দাম না বাড়ানোর ফলে এই অর্থবছরে পিডিবির ঘাটতি দাঁড়াবে তিন হাজার ৬০০ কোটি টাকা। কমিশন আশা করছে, এই অর্থ সরকার বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে (পিডিবি) ভর্তুকি হিসেবে দেবে।
আমদানি করা গ্যাস আসার পর বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম আবার বাড়ানো হবে কি-না এমন এক প্রশ্নের জবাবে কমিশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়, ‘প্রথম ধাপে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট পর্যন্ত এলএনজি ব্যবহারে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচে খুব একটা হেরফের হবে না, যাতে পাইকারি দর পরিবর্তন করার দরকার হবে। সরকার জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয় করলে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ কমে আসত।’ সে ক্ষেত্রে বৃদ্ধির পরিবর্তে আরও দাম কমানো যেত কি-না এমন প্রশ্নের জবাবে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, এখন যে অবস্থায় দর আছে, তা ধরেই হিসাব করা হয়েছে। ভবিষ্যতে সরকার দাম পুনর্নির্ধারণ করলে তা বিবেচনায় নেওয়া যেতে পারে।
পাইকারি পর্যায়ে দামের সমন্বয় :পাইকারি দর না বাড়লেও বিতরণ কোম্পানির জন্য বিদ্যুতের দাম সমন্বয় করা হয়েছে। এবার পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) এবং নর্দান পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (নেসকো) বিদ্যুতের ক্রয়মূল্য কমানো হয়েছে। অন্য বিতরণ কোম্পানির ক্ষেত্রে তা বাড়ানো হয়েছে। কমিশন আদেশে বলছে, পিডিবি বিতরণের জন্য গত অর্থবছরে বিদ্যুৎ কিনত পাঁচ টাকা ১২ পয়সায়। এখন ৩৩ পয়সা বাড়িয়ে এই দাম নির্ধারণ করা হয়েছে পাঁচ টাকা ৪৫ পয়সা। আরইবি চার টাকা ২৩ পয়সায় কিনত প্রতি ইউনিট। এখন ১৭ পয়সা কমিয়ে চার টাকা পাঁচ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছে। ডিপিডিসিকে পাঁচ টাকা ৮৫ পয়সায় কিনতে হতো। এখন কিনতে হবে আট পয়সা বাড়িয়ে পাঁচ টাকা ৯৩ পয়সায়। ডেসকোকে পাঁচ টাকা ৮৫ পয়সার স্থলে ২২ পয়সা বাড়িয়ে ছয় টাকা সাত পয়সা দরে কিনতে হবে। আর নেসকোর দাম ৬২ পয়সা কমিয়ে পাঁচ টাকা ১২ পয়সা থেকে চার টাকা ৫০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
সিদ্ধান্ত :এবার বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বিইআরসি ডিমান্ড চার্জ সার্ভিস চার্জকে মূল দরের সঙ্গে সমন্বয় করেছে। এর আগে বিতরণ কোম্পানিগুলো তাদের মতো করে অনেক ক্ষেত্রে এ অর্থ আদায় করত। এখন থেকে আর সে সুযোগ থাকছে না। প্রিপেইড মিটারের ক্ষেত্রেও এখন থেকে আর কোনো নিরাপত্তা জামানত (সিকিউরিটি ডিপোজিট) দিতে হবে না গ্রাহকদের। আর যেসব গ্রাহক প্রিপেইড মিটার ব্যবহার করবেন, তাদের আগের মিটারের সিকিউরিটি ডিপোজিট ফেরত দিতে হবে।
সংবাদ সম্মেলনে কমিশনের চেয়ারম্যান মনোয়ার ইসলামের সঙ্গে ছিলেন সদস্য আবদুল আজিজ খান, মাহমুদুল হক ভূঁইয়া, রহমান মুরশেদ ও মিজানুর রহমান।