সংবাদ ডেস্ক :: বাংলাদেশের গ্রাম গঞ্জে এক সময়ে গরু, মহিষ সহ গবাদিপশুর মৃতদেহ যেখানে নিয়ে ফেলা হতো সেখানে দলে দলে হাজির হতো শকুন। দ্রুত গতিতে তারা মৃত গবাধি পশুর মাংস খেয়ে সাবাড় করে দিত। মৃতদেহের রোগ জীবানু শকুনের পেটে দ্রুত ধ্বংস প্রাপ্ত হয়। লক্ষ লক্ষ বছর ধরে শকুনই প্রকৃতি হতে মৃতদেহ সরানোর কাজ করে রোগব্যাধী মুক্ত পরিবেশ সুরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। ফলে স্বাস্থ্যকর ও নিরাপদ পরিবেশ থাকতো। গবাদিপশুর মৃত দেহের রোগ জীবানু মরে না। এগুলো সংক্রমিত হয়। শকুন এগুলো খেয়ে ফেললে রোগ বিস্তার রোধ হতো। কিন্তু এখন আর আগের মতো শকুন দেখা যায় না। মহাবিপন্নের তালিকায় রয়েছে পরিবেশ রক্ষাকারী এই পাখি বাংলা শকুন।
বিজ্ঞানীরা বলেছেন যে, শকুন না থাকার কারনে বাংলাদেশে অ্যানথ্রাক্স, যক্ষ্মা, ক্ষুরা রোগ ইত্যাদি মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ার এবং জলাত্মঙ্ক রোগ বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বেড়েছে। শকুন না থাকায় গবাদিপশুর মৃতদেহ এখন শিয়াল, কুকুর, ইঁদুর, কাক, চিল সহ অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রাণী খাচ্ছে। এদের পেটে রোগ জীবানু নষ্ট না হওয়ায় জংগল ও জনপদে পড়ছে এসব মারাত্মক ব্যাধি।
সারা পৃথিবী জুড়ে শকুনের অবস্থা খুবই খারাপ ও ভয়াবহ। পরিবেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়োজনীয় পাখি শকুন। কিন্তু গবেষকরা জানিয়েছেন পৃথিবীতে প্রায় ৯০ ভাগ শকুন আর নেই। এজন্যই প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্যহীনতার পাশাপাশি অ্যানথ্রাক্স, যক্ষ্মা, ক্ষুরা, পানিবাহিতসহ বিভিন্ন রোগ ব্যাধি বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অফ নেচার (আইইউসিএন) এর ক্রিটিক্যালি এন্ডেনজার্ড এর তালিকায় রয়েছে শকুনের সব ক’টি প্রজাতি। কিন্তু বিগত ৩ দশকে বাংলাদেশে প্রায় ৯৯ ভাগ শকুন মারা গেছে। অবশিষ্ট এক ভাগও এখন মৃত্যু মুখে পতিত হচ্ছে। গবাধি পশু চিকিৎসায় ‘ডাইক্লোফেনাক’ দেয়া গরু, মহিষ, ছাগল মারা গেলে ওই মৃত দেহ খেয়ে শকুনের কিডনী নষ্ট হয়ে অল্প সময়ের মধ্যে মারা যায়। এছাড়াও বাংলাদেশের গ্রামে গঞ্জে বড় বড় প্রাচীন বৃক্ষরাজিতে বসতি গড়তো শকুন, বংশবৃদ্ধিও ছিল সন্তোষজনক। কিন্তু কালের পরিক্রমায় বর্তমানে শকুনের বসতি তৈরী ও বিশ্রাম নেয়ার মতো বড় গাছ প্রায় নাই বললেই চলে। সরকারি বন, অন্যান্য বনাঞ্চল ও গ্রাম গঞ্জের বড় গাছের পরিমাণ একই হারে কমে গেছে। ফলে গত ৩ যুগে বাংলা শকুনের পরিমাণ আশংকাজনক হারে কমে গেছে।
প্রাণি গবেষক তানিয়া খান বলেন, বাংলাদেশে শকুনের ৭ টি প্রজাতির মধ্যে ‘বাংলা শকুন’ আমাদের পাখি। অতীতে দেখা গেছে মরা গরু ফেলা হলে দলে দলে শকুন আসতো। সবগুলো খেয়ে ফেলতো। গরু, ছাগল মারা গেলে যেখানে সেখানে ফেলা হতো। এদের মৃত দেহের রোগ জীবানু মরে না। এগুলো সংক্রমিত হয়। শকুন এগুলো খেয়ে ফেললে রোগ বিস্তার রোধ হয়। কিন্তু ৯৫ থেকে ৯৮ ভাগ শকুন নেই। ফলে যক্ষ্মা, অ্যানথ্যাক্স সহ পানি বাহিত রোগ বাড়ছে শকুনের অভাবে। তাছাড়া শকুনের খাবার ও বাসস্থানের তীব্র সংকট রয়েছে। তিনি আশঙ্কা ব্যক্ত করে বলেন, গবাধি পশুর চিকিৎসায় ‘ডাইক্লোফেনাক’ এর পরিবর্তে আরো মারাত্মক ‘কেটোপ্রোফেন’ ব্যবহৃত হচ্ছে। যেগুলো শকুনের দ্রুত বিলুপ্তি ঘটাতে সক্ষম।
জানা গেছে, শকুন বিলুপ্ত হওয়ার আরো বড় একটি কারণ বাসস্থানের অভাব। প্রাকৃতিকভাবে বেড়ে উঠা প্রাচীন বৃহদাকার গাছগুলি ছিল শকুনের বিচরন ভূমি। শিমুল, ছাতিম, দেবদারুর মত প্রাচীনতম বৃহদাকার গাছগুলো এখন আর চোখে পড়ে না। এই ধরণের বড় ও উচুঁ গাছগুলিতে শকুন বাসা বাঁধে। পৃথিবীতে ২৩ প্রজাতির শকুনের মধ্যে বাংলাদেশে শকুন, রাজ শকুন, সাদা গিদরী বা গিন্নী শকুন, লম্বা ঠোঁট শকুন আমাদের দেশিয় প্রজাতি। আর ভ্রমনকারী হিসেবে ছিল হিমালয়ী শকুন, কালো শকুন আর গ্রিফন শকুন। সত্তরের দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির বুদ্ধ নারিকেল গাছের আর পলাশি ব্যারাকের কাছের উচুঁ গাছগুলোতে দেখা যেতো বাংলা শকুনের। এর বৈজ্ঞানিক নাম জেপস বেঙ্গালেনসিস (এুঢ়ং নবহমধষবহংরং)। গলা লম্বা, লোমহীন মাথা ও গলা গাঢ় ধূসর। পশ্চাদেশের পালক সাদা। পা কালো। ডানা, পিঠ ও লেজ কালচে বাদামি। একই বাসা টিকটাক করে বছরের পর বছর ব্যবহার করে। স্ত্রী শকুন সাদা রঙের একটি মাত্র ডিম পাড়ে। শকুনের দৃষ্টিশক্তি অসাধারণ তীক্ষ্ম। সেপ্টেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত তাদের প্রজননকাল। ৪৫-৫০ দিনে ডিম ফোটে। এদেশে বেশি দেখা যেত বলেই তাদের নামের শেষে বাংলা শব্দটি চলে এসেছে।
বাংলাদেশে বাংলা শকুন এখন বিরল প্রজাতি। বর্তমানে এরা মহাবিপন্ন। দিন দিন এদের খাবার একেবারেই কমে এসেছে। সবমিলে এদেশে এদের সংখ্যা পাঁচ থেকে সাতশ’র বেশি হবে না এবং গোটা বাংলাদেশে সব মিলিয়ে মোট শকুনের সংখ্যা দু’হাজারটিও নয় বলে গবেষকদের ধারণা। এদের বেশির ভাগ সুন্দরবন এলাকায় এবং কয়েকটি দল শ্রীমঙ্গলের কালাছড়া ও হবিগঞ্জের রেমা কালেঙ্গা এলাকায় রয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে এ দেশ শকুন শুন্য হয়ে পড়বে বলে সংশ্লিষ্টরা আশঙ্কা করছেন।
গবেষকরা শকুনের বিলুপ্তির কারণ হিসাবে চিহ্নিত করেছেন গবাধি পশুর জন্য ব্যবহৃত ডাইক্লোফেনাক ও কেটোপ্রোফেনের ব্যবহার। এ দু’টো ঔষধের প্রভাব মৃত গবাধি পশুর দেহেও থাকে। এ ঔষধ প্রয়োগ করা হয়েছে এমন কোন মৃতদেহ শকুনের খাদ্য তালিকায় চলে এলে শকুনের মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। আইইউসিএন-এর সহযোগী সংগঠন বার্ডসলিস্ট অর্গানাইজেশন উল্লেখ করেছে, কীটনাশক ও সারের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে পানির দূষণ, খাদ্য সঙ্কট, কবিরাজি ঔষধ তৈরিতে শকুনের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ব্যবহার, বিমান-ট্রেনের সাথে সংঘর্ষ, ঘুড়ির সুতার সাথে জড়িয়ে পড়া, ইউরিক এসিডের প্রভাবে বিভিন্ন রোগ, বাসস্থানের অভাব প্রভৃতি কারণে শকুন বিলুপ্ত হচ্ছে। শকুন পরিবেশের জন্য খুবই উপকারী পাখি। অ্যানথ্রাক্স ব্যাকটেরিয়া, খুরা রোগ, গবাধি পশুর যক্ষ্মা, কলেরার জীবানু খুব সহজেই শকুন হজম করতে সক্ষম।
এখনই উপযুক্ত পদক্ষেপ না নিলে ‘বাংলা শকুন’ বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। ভারত, পাকিস্তান, নেপালে বেশ আগেই ‘ডাইক্লোফেনাক’ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বাংলাদেশেও সম্প্রতি সময়ে ডাইক্লোফেনাক নিষিদ্ধ করা হলেও কেটোপ্রোফেন এর ব্যবহার মারাত্মক হারে বৃদ্ধি পাওয়ায় সংশ্লিষ্টরা উদ্বেগ প্রকাশ করছেন। পর্যাপ্ত তদারকি না থাকায় ওই সব ঔষধ উৎপাদন ও মাঠ পর্যায়ে ব্যবহার প্রায় আগের মতোই রয়ে গেছে। ফলে কাঙ্খিত ফল পাওয়া যাচ্ছে না।