সংবাদ ডেস্ক :: এক সময় গ্রাম-গঞ্জে দেখা যেতো বেধের বহর। তারা জীবিকার সন্ধানে যাযাবরের মতো নৌকায় করে এঘাট-ওঘাট ঘুরে বাড়াত। বিভিন্ন নদ-নদীর তীরে এরা অস্থায়ীভাবে বস গড়ে তুলতো। আর গ্রামে-গঞ্জে অথবা বাড়ি-বাড়ি গিয়ে দেখাতো হরেক রকমের খেলা। সাপের খেলা, কখনো ঝাঁড়-ফুক অথবা শিঙা লাগায় বলে বিভিন্ন ধনি উচ্চারণ করে এরা জীবিকার নির্বাহ করতো।

এর মধ্যে বেশির ভাগই নানা ধরনের অবৈজ্ঞানিক চিকিৎসার নামে টোককা, শিঙা লাগানোর নামে অপচিকিৎসা করে মানুষের কাছ থেকে আয় করত। তাদের একটি অংশ চুড়ি, থালাবাসন বিক্রি, সাপের খেলা দেখানোর কাজ করেও আয় করত। এ আয় দিয়েই চলত তাদের সংসার। কালের বিবর্তনে এসবের চাহিদা কমে যাওয়ায় তাদের ব্যবসায়ও মন্দা দেখা দিয়েছে। ফলে বেদে সম্প্রদায় ব্যবসা বদল করছে। তারা আগের ব্যবসা ছেড়ে এখন নতুন করে মৌসুমি ব্যবসা শুরু করেছে। তাদের অনেকে গ্রামে বা শহরের বিভিন্ন মেলায় অংশ নিচ্ছে। পণ্য হিসেবে থাকছে খেলনা, চুড়ি, মেয়েদের সাজগোজের নানা সামগ্রী, কসমেটিক্স। এ ছাড়া অনেকে সাপ বিক্রি করেও আয় করছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের এক গবেষণায় দেখা গেছে, বেদে সম্পদায়ের অস্তিত্ব এখন বিলুপ্তির পথে। ক্রমেই তাদের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। বেদেদের নতুন প্রজন্ম আর তাদের পুরনো পেশায় থাকছে না। তারা নতুন নতুন পেশা বেছে নিচ্ছে। এর কারণ হিসেবে গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়ছে। ফলে বেদেনির্ভর অপচিকিৎসা থেকে মানুষ মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। এসব কারণে তাদের আয়ও কমে গেছে। বিশেষ করে গ্রামের হাটবাজারকেন্দ্রিক বেদে সম্প্রদায়ের ব্যবসা-বাণিজ্যও কমে গেছে। এসব কারণে বাধ্য হয়ে তারা পেশা বদল করছে।

 

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মেজবাহ কামাল বলেন, হাজার বছর ধরে বাংলা সংস্কৃতির একটি উপাদান হয়ে রয়েছে বেদে সম্প্রদায়। বিশেষ করে ময়মনসিংহ গীতিকায় বেদে সম্প্রদায়ের একটি বড় অংশ রয়েছে। এগুলোকে হারিয়ে যেতে না দিয়ে বাংলার ঐতিহ্য হিসেবে সরংক্ষণ করা উচিত। এ জন্য তাদের জীবন-মান উন্নয়নের ব্যবস্থা নিতে হবে। পাশাপাশি তাদের সামাজিক ও আর্থিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।

গবেষকরা জানান, ঐহিত্যগতভাবেই বেদে সম্প্রদায় মানে ভ্রমণশীল বা ভবঘুরে। তাদের জীবনযাপন, আচার-আচরণ সবকিছু চলে একটি ভিন্ন সংস্কৃতিতে। ভবঘুরে হওয়ায় নদীনির্ভর বাংলাদেশে বেদেদের বাহন তাই হয়ে ওঠে নৌকা। এ সম্প্রদায়ের বাস সাধারণত নদীর পাড় কিংবা কোনো পতিত জায়গায়। নৌকাতেই সংসার আবার নৌকা নিয়ে ঘুরে বেড়ানো দেশ-দেশান্তরে। এর মাধ্যমেই তারা আয় করে জীবিকা নির্বাহ করে। রাজধানী ঢাকা, সাভার, মুন্সীগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, গাজীপুরের জয়দেবপুর, চট্টগ্রামের হাটহাজারী, মিরসরাই, তিনটুরী, কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম, চান্দিনা, এনায়েতগঞ্জ, ফেনীর সোনাগাজী, উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় বেদেদের আবাসস্থান। সুনামগঞ্জের সোনাপুরে বাস করে বেদেদের বৃহত্তর একটি অংশ। বেদেদের সমাজব্যবস্থা মাতৃতান্ত্রিক। এই সম্প্রদায়ের নারীরা যথেষ্ট শ্রম দেয়। পুরুষরা সন্তানদের লালন-পালন করে। একই সঙ্গে নারীরা যথেষ্ট স্বাধীনতাও ভোগ করে। বেদে পুরুষরা অলস হয়। কায়িক পরিশ্রমকে তারা ঘণা করে। তবে বর্তমান সময়ে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। সওদাগর শ্রেণি নাম দিয়ে পুরুষতান্ত্রিক সমাজকাঠামো তৈরি হচ্ছে বেদেদের মধ্যে। বেদে সমাজের আয়ের প্রধান উৎস হচ্ছে সাপ খেলা দেখানো, ঝারফুঁক ব্যবসা, শিঙা লাগানো, তাবিজ-কবজ বিক্রি। শরীরে উল্কি এঁকেও তারা আয় করে। এ সময় বেদেনিরা বেশ সাজগোজ করে, কোমরে বিছা, গলায় গহনা, খোঁপায় ফুল আর মুখে পান তাদের সাজের ধরন। মানুষকে আকর্ষণ করার জন্যই তাদের এমন সাজগোজ। গ্রামগঞ্জেই তাদের ব্যবসার মূল কেন্দ্রস্থল। কিন্তু আধুনিকতার কারণে তাদের ব্যবসায় এসেছে মন্দা।

চাঁদপুরের বেদেরা মূলত বেপারি সম্প্রদায়ের। জীবন বাঁচাতে বেশিরভাগ বেদেই নদীতে সারাদিন মাছ ধরে।

সমাজসেবা অধিদপ্তরের হিসাবে সারাদেশে তাদের সংখ্যা প্রায় ৬৩ লাখ। যাদের মধ্যে দলিত প্রায় ৪০ লাখ, বেদে ৮ লাখ ও হরিজন ১৫ লাখ। অঞ্চলভেদে বাংলাদেশে তারা বাদিয়া, বেদিয়া, বাইদিয়া, বেদে, বেদেনি, বাইদ্যা, বাইদ্যানি, সাপুরে ইত্যাদি নামে পরিচিত।

পান্থপথ রোডে অবস্থানরত বেদে মলিকার বয়স ১৭। তিনি জানান, আমি সাপ খেলা দেখাই। মাঝে মাঝে রাত হয়ে যায় বাড়ি ফিরতে। আরেকজন বেদেনি কুসুম সোনারগাঁ হোটেলের কাছে ছোট্ট বাক্সে সাপ নিয়ে খেলা দেখান। তিনি বলেন, আমরা মা গ্রামে সাপ খেলা দেখান আর চুড়ি, ফিতা বিক্রি করেন। আগে দিনে ২০০-৩০০ টাকা আয় হতো। এখন আয় কমে গেছে। এখন আর মানুষ সাপ খেলা দেখে না। ফলে এখন আয় হয় গড়ে ১০০ থেকে ১৫০ টাকার মতো। তারা বলেন, আয় কমার কারণে দিনের খরচই মেটানো যায় না। ফলে সন্তানরা স্কুলে যেতে পারে না। আমাদের সেই সামর্থ্যটাও নেই যে তাদের লেখাপড়ার খরচ চালাব। খোলা আকাশের নিচেই আমাদের জীবন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here